গা ছমছমে ভূতের গল্প, ‘গোঁসাই বাড়ির ভূত’!

গোঁসাই বাড়ির ভূত
মানু গৌতম
পূর্ব বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট থানায় একটি অখ্যাত গ্রাম কুমারপুর, অজয় নদের বাঁকে একটি সবুজে ঘেরা গ্রাম। উনবিংশ শতকের গোড়াতেই প্রাইমারি স্কুল স্থাপিত হয়। ক্রমে ক্রমে তা হাইস্কুলে রূপান্তরিত হয় এবং ১৯৪৬ সালে সেটি সরকারি অনুমোদন লাভ করে। এটি বলার কারণ, এখানে প্রচুর শিক্ষিত মানুষের বাস, তাই কুসংস্কারও কম।
কিন্তু, একটি মাটির বহু পুরনো বাড়ি আছে যেটি বালিকা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে। সেটি বহুদিন ধরে পরিত্যক্ত অবস্থা আছে। বাড়িটির চারপাশে কোনও বাড়ি নেই। বাঁশ বন আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। তাছাড়াও এঁদো পুকুর ও বিভিন্ন ঝোঁপ ঝাড় বাড়িটিকে কার্যত হানা বাড়ির রূপ দিয়েছে। বাড়িটির মালিক বর্তমানে অতনু গোস্বামী। অতনু একজন গ্রামের পুরোহিত মধ্য ৪০ এর যুবক এবং প্রচুর শিষ্য শাখা আছে। একদিন বীরভূম জেলার খয়রাশোল অঞ্চলে নাগরাকেন্দা থেকে একজন শিষ্য আসে অতনুর বাড়ি। ঘটনার সূত্রপাত এখান থেকেই।
শিষ্যটির নাম তাপস মন্ডল। বছর ৫০ বয়স। সে এসেই রাত্রে শুয়ে একটা স্বপ্ন দেখে। সে দেখে, বাঁশ বাগানের মধ্যে একটি মাটির বাড়ি। সেই বাড়িটিতে বারান্দায় বসে পা দোলাচ্ছে একটি বিশেষ আকৃতির মানুষ, বয়সের দিকে ভাবলে ১২-১৩ বছরের বালক। চোখ দুটো ক্ষুদ্র কিন্তু তীক্ষ্ণ, যেন টর্চের আলো জ্বলছে । মাথা নেড়া, গায়ের রং ধবধবে সাদা। সে তাপসকে নাম ধরে ডাকছে, বলছে, আয় আমার কাছে আয়। এখান থেকে মুক্ত কর। তাপস যতবার ঘুমাবার চেষ্টা করে ও বারবারই ওই একই দৃশ্য দেখতে থাকে। পরদিন সকালে উঠে গুরু প্রণাম করে আগের রাতের ঘটনা সবিস্তারে বলে।
(BCREC & Group of institutions । পূর্ব ভারতের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। 933927844, 9832131164, 9932245570, 9434250472)
সব শুনে অতনু বলে, আমাদের ওই রকম একটা বাড়ি আছে। চলো দেখবে। তারপর তাপসকে ওই বাড়ির সামনে নিয়ে যায়। তাপস দেখেই বলে, হ্যাঁ, এই বাড়িটাই দেখেছি। গুরুদেবকে অনুরোধ করে ওই বাড়িটি খুলতে। অতনু বহু চেষ্টার পর ঘর খোলে। কিন্তু সেখানে এরকম কিছু ছিল না, যাতে কোনও সন্দেহ হয়। তাপস ভয় পায়। তাই বাড়ি যেতে চাইল কিন্তু গুরুদেবের অনুরোধ ঠেলতে পারল না। থেকেই গেল। ওইদিন রাতে আবার স্বপ্ন দেখল, সেই বালকটি তাকে ডাকছে। একসময় তাপস উঠে পড়ে যাবার জন্য। কিন্তু দরজায় তালা দেওয়া, তাই আর যাওয়া হয় না। আবার শুয়ে পড়ে। এবার স্বপ্নে একটি সবুজ দোতলা বাড়ি দেখে আর সেই বালকটি যেন হাঁটতে হাঁটতে ওই বাড়িতে ঢোকে। পরের দিন সকালে গুরুদেব কে সব বলে। আবারও অতনু বলে, এরকম একটি বাড়ি আমাদের গ্রামে আছে। চলো ওই বাড়িতে যাই। দুজনে ওই বাড়ির সামনে এল। তাপস বলল, এই বাড়িটাই স্বপ্নে দেখেছে। বাড়িটি হল, গ্রামের প্রাচীনতম ব্যক্তি হরিদাস তর্কালঙ্কারের বাড়ি। বয়স এখন ১০৫ বছর হবে। তার কেউই নেই, আত্মীয় বলতে একটি নাতি আছে। সেও কলকাতায় চাকরি করে। সেখানেই থাকে। একা ওই বৃদ্ধ বাস করে। সকালে একজন এসে দৈনন্দিন কাজ করে দেয় ও রান্না করে বাড়ি যায়। এ বাড়িতে আর সারাদিন কেউ আসে না।
তাই যখন তাপসকে নিয়ে অতনু ঢোকে তখন হরিদাস একটু অবাক হয়। তাদের বসতে বলে, তারপর কী উদ্দেশ্য জানতে চায়, তাপস তখন দুদিনের স্বপ্ন সব বলে। শুনেই হরিদাস বলে এত বছর পর আবার! তারপর থেমে যায় এবং জিজ্ঞাসা করে, তোমার বাড়ি কোথায়? তাপস বলে আমার বাড়ি বীরভূম জেলায় খয়রাশোল থানার নাগরাকেন্দা গ্রামে। হরিদাস হঠাৎ বলে ওঠে, আবার দুয়ে দুয়ে চার হয়েছে। তুমি কি মহেন্দ্র বলে কাউকে তোমাদের বংশের জানো? তাপস মনে করতে পারে না। হরিদাস বলে, তোমাকে বাড়ি যেতে হবে। এবং সব খোঁজ নিয়ে আবার আসতে হবে। তবে ঘটনাটা একটু শুনে যাও। তুমি স্বপ্নে যে বাড়িটি দেখেছো, ওটা হল অতনুর দাদুর বাবা হারাধন গোস্বামীর বসত বাড়ি। সালটা ১৮৯০ বা ৯৫ হবে ঠিক জানি না কারণ আমার তখন জন্ম হয়নি। তখন ওই জায়গায় ছিল গোস্বামী পাড়া। আর তার মধ্যমণি ছিল হারাধন গোস্বামী। বিদ্যাসাগরের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি বালিকাদের জন্য একটি টোল খোলেন। আজ যেখানে বালিকা বিদ্যালয়, ঠিক সেখানেই তার স্বপ্নের ওই বালিকাদের টোলটি ছিল। সেই টোলকে স্মরণে রাখতেই ওই বালিকা বিদ্যালয় তৈরী হয়। আর এক সমৃদ্ধ জনপদ ছিল গোঁসাই পাড়া। সবাই রাধা মাধবের সেবা করতেন আর পন্ডিত গিরি করতেন। সবার ছিলো প্রচুর শিষ্য শাখা।
(Dvita Eye Care। কলকাতার বাইরে সেরা চোখের হাসপাতাল। যোগাযোগ- 0343-6661111)
এই সময় একদিন মহেন্দ্র গুরু বাড়ি আসে সেই খয়রাশোল থেকে। এসে রাত্রে শুরু হয় কলেরা। দুইদিন ভোগার পর যখন মৃত্যু আসন্ন, তখন সে হারাধনকে বলে, গুরুদেব আমি খুবই অন্যায় করেছি। আমার বাবা কলেরায় মারা যায়। তার নাভি কুন্ডু গঙ্গা দেওয়ার জন্য নিয়ে যাচ্ছিলাম। পথে বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। তাই আমি আপনার বাড়ি আসি। এরপর আমি তার বাঁচব না। তাই আপনাকে অনুরোধ করছি, ওই নাভি কুন্ডটি আপনি সৎকার করে দেবেন। গুরুদেব জিজ্ঞেস করে নাভি কুন্ডটি কোথায়? উত্তরের মহেন্দ্র বলে, সদর দরজা ডান দিকে চালের বাতায় সাদা কাপড়ে মোড়া অবস্থায় গোঁজা আছে। গুরুদেব সেটি দেখবার জন্য সঙ্গে সঙ্গে সদর দরজায় যায়। কিন্তু সেখানে আর নাভিকুন্ডটি ছিল না। বহু খোঁজাখুঁজির পরও না পেয়ে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ল হারাধন। এদিকে সেই রাত্রেই মহেন্দ্র মারা যায়। এরপর ওই পাড়ায় মড়ক লেগে যায়। প্রতিটি বাড়িতেই শুরু হয় মৃত্যু মিছিল। বাড়ি বাড়ি হাহাকার পড়ে যায়। ভয়ে ওই পাড়ার সকলে নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে কেউ মাঝিগ্রাম, কেউ কাটোয়া চলে যায়। এমনকি হারাধনের স্ত্রী পাশের পাড়ায় বাপের বাড়ি চলে যায় তার শিশু পুত্রকে কোলে নিয়ে।
এরপর গ্রামের মাতব্বররা সিদ্ধান্ত নেয়, কিছু একটা করা দরকার এবং একজন সাধু বাবার সাথে যোগাযোগ করে। সেই সাধুবাবা বিধান দেন, ওই পাড়াটিকে সকলে এড়িয়ে যেতে হবে এবং গ্রামের দক্ষিণ সীমান্তে পুজো দিতে হবে। তাই সকলে মিলে গ্রামের দক্ষিণ দিকে একটি অশ্বত্থ গাছ তলায় মা রক্ষা কালীকে প্রতিষ্ঠা করে এবং পুজো করতে শুরু করে। পুজোটি প্রথম চালু হয় বৈশাখ মাসের প্রথম মঙ্গলবার যা আজও গ্রামের লোক নিষ্ঠা সহকারে পালন করে আসছে। ওই পাড়ার কাছ দিয়ে সকলে যাতায়াত বন্ধ করে দেয়। তারপর মড়ক বন্ধ হয় । কিন্তু শুরু হয় আর এক উপদ্রব। ওই এলাকায় রাত্রে গেলেই অনেকে দেখতে পেতো, তেঁতুল গাছ তলায় একজন নেড়া মাথা বালক সাদা ধবধবে রং, ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার চোখ দুটি যেন দুটি টর্চ লাইট জ্বলছে। আর ওই চোখের সামনে যে পড়তো তার মৃত্যু ছিল অবশ্যম্ভাবী। এইভাবে প্রায়ই গ্রামে অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটতে লাগল এমনকি আমার বাবা জ্যোতিপ্রিয় তর্কালঙ্কার একদিন ওই রাস্তা দিয়ে পুজো করে বাড়ি ফেরার পথে দেখতে পায়, ছেলেটি তেঁতুল তলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, সাথে একটি কৃশকায় লম্বা, কালো এবং সাদা কাপড় গায়ে দিয়ে এক ব্যক্তি। তারা বাবার দিকে আসতে থাকে এবং যেই ছেলেটি বাবার দিকে তাকায়, বাবার শরীর যেন পুড়ে যেতে থাকে। বাবা কোনওক্রমে রাম নাম জপ করতে করতে বাড়ি ফেরে এবং রাত্রে প্রবল জ্বর আর জ্বরের ঘোরে কেবলই বলছে, আমায় কে যেন গলা চেপে ধরেছে, আমাকে রক্ষা করো। ওই সাদা ছেলেটা আসছে। ওই কালো লোকটা আমায় গলা টিপে ধরল। এইভাবে ভোর বেলায় আমার বাবার মৃত্যু ঘটে।
(The Mission Hospital. দেশের সেরা চতুর্থ হাসপাতাল এখন দুর্গাপুরে। যোগাযোগ- 8687500500)
এরপর সন্ধ্যা লাগলে গ্রামের কেউ আর ওই রাস্তায় যেত না। কিন্তু ওই বালকটিও বসেছিল না। সেও তার এলাকা বাড়াতে লাগলো। সে ওই বাড়ি থেকে বের হয়ে হাজরাপাড়া হয়ে কুমোর পাড়া এবং সেখান থেকে পাড়ার পাশ হয়ে তেলিপাড়ার উপর হয়ে চলে যেত। কিন্তু ওই ছেলেটির মুখটি বাম দিকে ঘুরে থাকতো তাই ওই রাস্তার বাম দিক সব শ্মশানে পরিণত হতে লাগে। তখন আবার গ্রামের মাতব্বরগণ এক জায়গা হয়ে সিদ্ধান্ত করে সেই সাধু বাবাকে আবার আনতে হবে। এবং কথামতো সেই সাধু বাবাকে আবার আনা হয়। এরপর সাধুবাবা বিধান দেন ওটা হল পুষ্কর ভূত। ওকে তাড়ানো সম্ভব নয়। কিন্তু যেটা সম্ভব সেটা হচ্ছে, ওকে ওই বাড়িতেই বন্দি রাখা। তার জন্য কি করতে হবে সকলে শুনে নাও। যে দিকে ওই পুষ্কর ভূত যাতায়াত করে সেই প্রত্যেকটি মোড়ে নাম সংকীর্তনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে ওই রাস্তা আর ও ব্যবহার করতে পারবে না। সেইমতো ওই বাড়ির থেকে যেসব রাস্তাগুলি বের হয়েছে সেই রাস্তার প্রতিটি বাঁকে অষ্টপ্রহর নাম সংকীর্তন এর ব্যবস্থা করা হয়।
একসময় পুষ্কর ভূতের দাপট কমে যায়, সে ওই বাড়িতে অবরুদ্ধ হয়। কালের করালগ্রাসে নাম সংকীর্তন অনেক জায়গায় উঠে গেলেও হাজরা পাড়ার মোড় এবং তিলি পাড়ার মোড়ে আজও তা চালু আছে। এরপর কুমারপুর গ্রামবাসী বিগত ৭০-৮০ বছর আর কোনও উপদ্রবের শিকার হয়নি। কেবলমাত্র ওই বাড়িটিকে সাধু ভাঙতে বারণ করেছিল কারণ পুষ্কর ভূতের নাকি একটি আশ্রয়ের দরকার। তাই অতনুর পরিবার ওই ঘরটিকে আজও টিকিয়ে রেখেছে। কিন্তু সাহস করে ওই পাড়ায় আজও কেউ বসতি স্থাপন করেনি। তাই ওই বাড়িটির চারিদিকে বিশাল বনের সৃষ্টি হয়েছে। এখন মনে হচ্ছে তাপস, মহেন্দ্র তোমার বংশের কেউ ছিল তাই তুমি এখানে চলে আসায় তোমাকে সে মুক্তি লাভের জন্য ডাকছে। তুমি বাড়ি ফিরে যাও এবং ওখানে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানো মহেন্দ্র সত্যিই তোমার পূর্বপুরুষ ছিল কিনা. যদি থাকে তবে তুমি আবার ফিরে এসো এবং ওদের সৎকারের ব্যবস্থা করে ওদের মুক্তির ব্যবস্থা করো।
(BCREC & Group of institutions । পূর্ব ভারতের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। 933927844, 9832131164, 9932245570, 9434250472)
এই উপদেশ তাপস গ্রহণ করে এবং সে খয়রাশোলের নাগরাকোদার বাড়িতে ফিরে যায়। বহু দলিল দস্তাবেজ ঘেঁটে অবশেষে বের করতে সক্ষম হয় যে মহেন্দ্র সত্যিই তাদের পূর্বপুরুষ এবং এই পূর্ব পুরুষকে মুক্তি দেবার জন্য মহেন্দ্র যথেষ্ট টাকা-পয়সা নিয়ে আবার কিছুদিন পর কুমারপুরে আসে। এরপর তর্কালঙ্কার মহাশয়ের নির্দেশ মতো ওই বাড়ি পরিষ্কার করা হয় আর ওইদিনই তাপস ফের স্বপ্ন দেখে, ওই ছেলেটি সেই বারান্দায় বসে মিটিমিটি হাসছে। আর তাপসের দিকে হাত তুলে আশীর্বাদ করছে। পরের দিন প্রথমে একটি কুশপুত্তলিকা তৈরি করে তার মুখাগ্নি করা হয় এবং অজয়ের তীরে দাহ করা হয়। এরপর তিনদিন চলে অশৌচ পালন। চতুর্থ দিন শ্রাদ্ধ শান্তি করা হয়। পরের দিন অনুষ্ঠিত হয় ১০ হাজার বার কালী মন্ত্র জপ এবং এক হাজার বার আহুতি দিয়ে হোম। আর সাথে চলে অষ্টপ্রহর হরিনাম সংকীর্তন। সবশেষে হয় নর নারায়ণ ভোজন। কিন্তু সেখানেও এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। অসংখ্য এঁটো শাল পাতার মধ্যে একটি পাতা হঠাৎ ঘুরতে ঘুরতে সোজা আকাশে উঠে সকলের দৃষ্টির অগোচরে চলে যায়, কেবলমাত্র তাপস দেখতে পায় সেই পাতার উপর বসে ওই পুষ্কর ভূত রূপী মহেন্দ্র মিটিমিটি হাসতে হাসতে মহেন্দ্রকে আশীর্বাদ করতে করতে নীলিমায় বিলীন হয়ে যায়।
(Dvita Eye Care। কলকাতার বাইরে সেরা চোখের হাসপাতাল। যোগাযোগ- 0343-6661111)