দূরদর্শী রাজীব গান্ধী, টাওয়ার টেলিফোন ও কিছু তথাকথিত ‘হ্যাকার’!

দূরদর্শী রাজীব গান্ধী, টাওয়ার টেলিফোন ও কিছু তথাকথিত ‘হ্যাকার’!
WhatsApp Group Join Now
Instagram Group Join Now

ধীমান জহরী

সে এক দিন ছিল! মোবাইল ফোন আসতে তখনও ঢের দেরি। শহরে তখন পিসিও-র রমরমা। গ্রামে তখন টাওয়ার টেলিফোন। ‘পিসিও’ কী প্রায় সবাই জানেন। তবে টাওয়ার টেলিফোন কী, তা সম্ভবত অনেকেই জানেন না!

তখন অধিকাংশ গ্রামে একটিই টেলিফোন সংযোগ ছিল। তারের সংযোগ নয়। অনেকটা আজকের মোবাইল ফোনের মতো টাওয়ার দিয়েই বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা হত। পার্থক্য একটাই, আজকের একটি মোবাইলের টাওয়ার থেকে হাজার হাজার মোবাইলের সংযোগ দেওয়া যায়। কিন্তু গ্রামের সেই টাওয়ার থেকে একটি মাত্র টেলিফোনের সংযোগ থাকত। সেই টেলিফোনটি ছিল সর্বজনীন। সারা গ্রামের লোক নির্দিষ্ট সরকারি চার্জ দিয়ে সেই টেলিফোন ব্যবহার করত।

তখন এই টাওয়ার টেলিফোনের সূত্রে গ্রামে গঞ্জে কিছু এঁচোড়ে পাকা তথাকথিত ‘হ্যাকার’ তৈরি হয়েছিল। রেডিওপ্রেমীদের কাছে সেই সময় একটি কমদামী চীনা রেডিয়ো জনপ্রিয় ছিল। কিচিবো কোম্পানির রেডিয়ো। ডেঁপো ছেলে ছোকড়ার দল সেই রেডিয়োর ‘আউট অফ ব্যান্ড ফ্রিকোয়েন্সি’ দিয়ে মাঝে মাঝে টাওয়ার টেলিফোন ‘হ্যাক’ করতে সমর্থ্য হত! এই গ্রামের টেঁপি পাশের গ্রামের টেঁপার সঙ্গে কী কথা বলছে, কার বাড়িতে বিয়ে লেগেছে, কার বাড়িতে কে মৃত্যু শয্যায়, এমন সব নানা খবর তারা টেলিফোনের কথোপকথন শুনে পেয়ে যেত। আবার, কদাচিৎ কোনও বিমানবন্দরের এটিসি টাওয়ারের গুরুত্বপূর্ণ কথোপকথনও ধরা পড়ত সেই রেডিয়োতে। এটিসি ব্যাঙ্গালোর থেকে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমানকে কত ফুট উচ্চতায় উঠতে হবে, এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান কোন রানওয়েতে নামবে, সেই সব নির্দেশের গোপন বার্তা শুনে ফেলার রোমাঞ্চ, তারপরে বন্ধুদের কাছে সে সব উগলে দেওয়ার সময় নিজেকে ‘র’-এর এজেন্ট মনে করা, সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা!

ভারতবর্ষের গ্রামে গ্রামে টেলিফোন চালু করার পথিকৃৎ হিসাবে কৃতিত্বের অধিকারী নিঃসন্দেহে প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। আটের দশক। তখন শহরেই টেলিফোন সংযোগ পেতে ১০ বছর লাগত। সেখানে গ্রামে তো ভাবাই যায় না। তখন সারা দেশে টেলিফোনের সংখ্যা ছিল মাত্র ২ মিলিয়ন। এই ব্যবস্থা বদলাতে উদ্যোগী হলেন নতুন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। গ্রামে গ্রামে টেলিফোন সংযোগ চাই। দেশের প্রতিটি কোণায় উন্নয়ন পৌঁছে দিতে দরকার উন্নত টেলি যোগাযোগ ব্যবস্থা। ১৯৮৪ সালে রাজীব নিয়ে এলেন মার্কিন প্রযুক্তি শিল্পে কর্মরত খ্যাতিমান টেকনোক্র্যাট, ঘনিষ্ঠ স্যাম পিত্রোদাকে। টেলিকম কমিশনের প্রধান হিসেবে নিয়োগ করা হল তাঁকে। টেলিফোনের সংখ্যা বাড়ানোর চেয়ে প্রত্যন্ত গ্রামে টেলিফোন সংযোগ স্থাপনে গুরুত্ব দিতে বলা হল স্যামকে। সেই অনুযায়ী তৈরি হল নীতি। পরবর্তী কয়েক বছরে দেশের অধিকাংশ প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছে গেল সেই টাওয়ার টেলিফোন, যা নিয়ে শুরু হয়েছিল এই লেখাটি। সেই সূত্র ধরেই কয়েক বছর পরে দেশের মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে যায় মোবাইল ফোন-ও।

হায়! যখন তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশের প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে টাওয়ার টেলিফোন পৌঁছে দেওয়ার প্রকল্প রূপায়ণের কাজ শেষ হল, তার আগেই ১৯৯১ সালে তিনি ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছেন এলটিটিই-র আত্মঘাতী বোমারুর হামলায়। সেই ঘটনা নিয়ে সম্প্রতি নির্মাণ করা হয়েছে সাত পর্বের ওয়েবসিরিজ় ‘দ্য হান্ট – দ্য রাজীব গান্ধী অ্যাসাসিনেশন কেস’। পরবর্তী লেখায় সেই সিরিজ নিয়ে আলোচনা করব।

 

Highlight
error: Content is protected !!